লটকনের উপকারিতা - লটকন খেলে সারবে যেসব রোগ
আপনি কি এমন একটি ফল খুঁজছেন? যেটাতে খাদ্য শক্তি হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন,
শরকরা, আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ, খনিজ ইত্যাদি পুষ্টিগুন ও নানাবিধ
উপকারিতায় ভরপুর থাকবে। প্রিয় পাঠক চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেটি কোন ফল!
সম্মানিত পাঠক আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানতে পারবেন টক মিষ্টি স্বাদে
ভরপুর হলুদ রঙের ছোট্ট একটি নিরীহ ফল লটকনের উপকারিতা সম্পর্কে। তাহলে চলুন জেনে
নেওয়া যাক লটকনের উপকারিতা এবং লটকন খেলে সারবে যেসব রোগ সেই সম্পর্কে।
বিস্তারিত জানতে পোস্টটি সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়ুন!
পেজ সূচিপত্রঃ
.
ভুমিকা
লটকন হল টক মিষ্টি স্বাদের দারুন একটি ফল। এই ফলটি কাঁচা অবস্থাতে সবুজ বর্ণের ও
পাকলে হলুদ রংবিশিষ্ট হয়। এটি ছোট্ট ও গোলাকার হয়ে থাকে। এই ফলটি ছোট হতে পারে
কিন্তু এর পুষ্টিগুণ, উপকারিতা ও কার্যকরিতার দিক দিয়ে অন্যন্য ফলের চেয়ে অনেক
এগিয়ে রয়েছে। আশা করি এই আর্টিকেলটি ধৈর্য সহকারে সম্পূর্ণ পড়লে লটকনের
উপকারিতা সম্পর্কে অনেক অবাক করা জাদুকরী তথ্য বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন।
লটকন ফল কি
এক ধরনের টক মিষ্টি স্বাদে ভরপুর হলুদ রঙের ছোট্ট গোলাকার নিরীহ ফল লটকন। লটকনের
অনেক পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা রয়েছে। লটকন ফলটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার বুনো ফল হিসেবে
পরিচিত ছিল। বর্তমানে লটকন ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া,
থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়ার কারণে স্বদেশীয় ফল হিসেবে
এটি পরিচিত লাভ করেছে। লটকন ফলের
আকার সাধারণত দুই সেমি থেকে ৫ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। অর্থাৎ ০.৫ থেকে ১.৯৭
ইঞ্চি লম্বা এবং চওড়া হয়ে থাকে। প্রতিটি ফলের উপরের অংশ মকমল গোলাপী বা হলুদ
বর্ণের হয়ে থাকে। পাকার সময় ভিতরের অংশে বীজ বা কুয়া গুলো সাদা বা বাদামি
বর্ণের হয়ে থাকে। লটকনের এক একটি ফলে সর্বনিম্ন দুইটি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচটি
পর্যন্ত কুয়া বা বীজ হয়। লটকন ফলের বীজ বা কুয়ার উপর লেগে
থাকা রসালো অংশ মানুষ সাধারণত খায়। লটকন ফল জাত ভেদে কিছুটা টক বা টকমিষ্টি
স্বাদের হয়ে থাকে। এই ফল অনেকের সরাসরি খেয়ে থাকে। আবার অনেকেই রান্না করেও
খায় । আবার অনেকেই এর জ্যাম, ওয়াইন তৈরি করে খায়। এক সময় বাংলাদেশে লটকন ফল
একটি অপ্রচলিত ফলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এই ফল বর্তমানে
বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হওয়ার কারণে এর উৎপাদন
ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই কারণে বর্তমান সময়ে উন্নত জাতের অনেক ধরনের সুমিষ্ট
লটকন ফল পাওয়া যাচ্ছে। সাথে সাথে বাংলাদেশে এই লটকন ফলের চাষাবাদ বৃদ্ধির ফলে এর
অনেক জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। প্রথমদিকে বাংলাদেশের নরসিংদী জেলাতেই একমাত্র লটকন
ফলের চাষাবাদ হত। কিন্তু
বর্তমানে সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল,
কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুর সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইদানিং বাণিজ্যিকভাবে
লটকনের চাষাবাদ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এইজন্যই মূলত এখন লটকন বাংলাদেশী ফল
হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।
লটকনের ইংরেজি নাম
লটকন ফলের বিভিন্ন এলাকায় বা অঞ্চল ভেদে অনেকগুলো নাম রয়েছে। আবার লটকন ফলের
সুন্দর ইংরেজি নামও রয়েছে। সেটা হল Burmese Grape(বার্মিজ গ্রেপ)। লটকন কে
বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। যেমন বগি, লটকা, বুবি, ডুবি,
লটকাউ, কিছুয়ান, হাড়ফাটা, কানাইজু, রামবাই, রাম্বি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে
থাকে। আবার এটিকে থাইল্যান্ডি ভাষায় মাফাই-ফারাং বলা হয়।
লটকনের বৈজ্ঞানিক নাম
বিভিন্ন দেশে বা এলাকায় অঞ্চল ভেদে যেমন লটকনের অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাংলায়
নাম রয়েছে। তেমনিভাবে এর সুন্দর একটি ইংরেজি নামও রয়েছে। আবার এর একটি অনেক
চমৎকার বৈজ্ঞানিক নামও রয়েছে। আর লটকনের বৈজ্ঞানিক নাম হিসেবে
Baccaurea Motleyana, Baccaurea Sapida নামে সবার কাছে বহুল পরিচিত।
লটকন চাষ পদ্ধতি
লটকন চাষ পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। লটকন চাষ করার জন্য বিশেষ কোনো ধরনের মাটির
প্রয়োজন হয় না। বরং শুনিসকাশ যুক্ত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই লটকনের সুন্দরভাবে
চাষ করা যায়। তবে এক্ষেত্রে বেলে দো-আঁশ মাটি হলে লটকন চাষ সবচেয়ে উপযোগী হয়।
এছাড়াও লটকন গাছ স্যাঁতসাঁতে ও আংশিক ছায়াময় পরিবেশেও ভালো জন্মায়। কিন্তু
জলাবদ্ধতা একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
লটকনের চারা রোপণ
সঠিক পদ্ধতিতে ও নির্দিষ্ট সময়ে লটকনের চারা রোপণ করলে অধিক পরিমাণে ফলন পাওয়া
যাবে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক লটকনের চারা রোপণের আদর্শ সময় কোনটি।
লটকনের কারা রোপণের সময়ঃ লটকনের চারা রোপণের আদর্শ ও উপযুক্ত সময় হচ্ছে
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) মাস। এছাড়াও বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন
(সেপ্টেম্বর) মাসেও লটকনের চারাগাছ রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।
লটকনের চারা রোপণের দূরত্বঃ বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ করলে লটকনের চারা
রোপণের ক্ষেত্রে দুইটি জিনিস খেয়াল রাখবেন!
- লটকনের চারা রোপণের ক্ষেত্রে একটি চারা থেকে অন্য আরেকটি চারার দূরত্ব হবে ৬ মিটার।
- লটকনের চারা রোপণের ক্ষেত্রে একটি সারি থেকে অন্য আরেকটি সারির দূরত্বও হতে হবে ৬ মিটার।
কৃষি উদ্যোক্তাদের পরামর্শ নিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে লটকন চাষ করলে খুব দ্রুতই লাভবান
হওয়া সম্ভব। এবং খুব ভালো ফলন আশা করা যাবে। লটকনের চারা রোপণ করার জন্য কয়েকটি
প্রসেস খুব ভালোভাবে করতে হবে।
লটকনের চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরিঃ লটকনের চারা রোপণ করার জন্য গর্তের
আকার ৯০ সেন্টিমিটার হতে হবে।
গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতিটি গর্তে গোবর বা জৈব সার ১৫ থেকে ২০ কেজি, টিএসপি
৫০০ গ্রাম ও এমপি ২৫০ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে
প্রতিটি গর্ত ভরাট করতে হবে।
গর্ত ভর্তি করার সময় মাটি শুকনা থাকলে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দিয়ে গর্তের মাটি
গুলো ভিজিয়ে দিতে হবে।
লটকনের চারা রোপণ পদ্ধতিঃ
- ভালোভাবে জমি সমতল করে নিয়ে বর্গকার বা আয়তাকার পদ্ধতিতে লটকনের চারা লাগানো যেতে পারে।
- মিশ্র সার দিয়ে গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মধ্যখানে নির্বাচিত চারা সোজা করে লাগিয়ে দিয়ে চারার চারিদিকে ভালোভাবে মাটি চাপা দিয়ে দিতে হবে।
- লটকনের চারা লাগানো হয়ে গেলে প্রতিদিন কমপক্ষে এক থেকে দুইবার চারা গাছে পানি দিতে হবে।
- চারাকে একটি মজবুত গাছে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনে পাশে একটি খুঁটি পুঁতে দিতে হবে। এবং চার সাইডে বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
লটকনের কোন জাতের চারা লাগাবেন
লটকনের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে চাষাবাদ করা যায়। তবে এতে করে লটকন ফলের
মাতৃগুণ বা স্বাদ বজায় থাকে না। এজন্য গুটি কলমের তৈরি চারা ব্যবহার করলে সব
থেকে ভালো হয়। এছাড়াও প্রথমে বীজ থেকে চারা তৈরি করে নিয়ে সেই চারাতে উন্নত
জাতের গ্রাফটিং করলেও ভালো হয়। গ্রাফটিং বা গুটি কলম করার জন্য সুস্থ, সবল, সতেজ
ও নীরোগ ডাল বা চারা নির্বাচন করে গুটি কলম
বা গ্রাফটিং করতে হয়। গ্রাফটিং বা গুটি কলম করার জন্য চিকন ও সামন্তরাল ডাল এ
কাজের জন্য উপযুক্ত। গুটি কলম বা গ্রাফটিং করে লটকন চাষ করলে চারারোপণের দুই তিন
বছরের মধ্যেই গাছে ফল আসতে শুরু করে। কিন্তু শুধুমাত্র বীজ বপন করে লটকন চাষ করলে
চারা বড় হতেই অনেকদিন সময় লাগে। ফলনও কম হয়। সাথে সাথে লটকন ফলের মাতৃগণ বা
মূল স্বাদটা হারিয়ে যায়। গাছে ফল আসতে মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লেগে
যায়।
লটকন গাছের পরিচর্যা
শুধুমাত্র গাছ বলে কথা নয় প্রতিটি জিনিসের ক্ষেত্রেই যত্নসহকারে পরিচর্যা করলে
সেটি সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে এবং পরবর্তী সময়ে সুন্দর ব্যাকআপ দিবে। এইজন্য ভালো
ফলন পেতে হলে পরিচর্যার কোন বিকল্প নেই।
সেচঃ
- চারা রোপণের প্রথম দিকে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। যাতে করে চারা গাছটি মাটির পরিবেশ ও আবহাওয়ার প্রতিকূল অবস্থাকে মানিয়ে নিয়ে সহজে বেড়ে উঠতে পারে।
- গাছে ফুল বা ফল ধরার পর শুকনো মৌসুমে শীতের শেষ দিকে দু-একবার সেচ দিলে ফলন বাড়বে সাথে সাথে ফলের আকারও বড় হবে।
ডাল ছাঁটাইঃ গাছের যাবতীয় মরা, রোগাক্রান্ত ও পোকা-মাকড় সংক্রামিত
ডালগুলোকে ভালোভাবে ছাটাই করে নিতে হবে।
পোকা-মাকড় দমন ও প্রতিকারঃ পোকা-মাকড়ের আক্রমণের ফলে গাছ এবং ফল এ দুটোই
যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এইজন্য ফল ছিদ্রকারী পোকা, মিলবাগ বা সাদামাছি,
স্কেল পোকা, চেপার বিটল এই ধরনের পোকা-মাকড় গাছকে আক্রমণ করলে কৃষি উদ্যোক্তার
পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী পারফেকথিয়ন বা লেবাসিড ৫০ ইসি, রগব বা রক্সিয়ন ৪০
ইসি, সুমিথিয়ন বা ডেবিকুইন ৪০ ইসি, এই প্রতিকার গুলো নিয়ে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার
বিধি মেনে প্রয়োগ করুন।
রোগবালাই দমন ও প্রতিকারঃ বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাইয়ের কারণে গাছ ও ফল
দুটোই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এইজন্য কৃষি উদ্যোক্তার পরামর্শ অনুযায়ী
এনন্থ্রাকনোজ বা কলেটোট্রিকাম সিডি ছত্রাক, ফিউজেরিয়াম উইল্ট বা হঠাৎ করে গাছ
মারা যাওয়া এই ধরনের রোগ বালাই গুলোর প্রতিকার জেনে সে অনুযায়ী দমন করতে হবে।
সার প্রয়োগঃ
- প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছের জন্য ১৫ থেকে ২০ কেজি গোবর বা জৈব সার, ১ কেজি ইউরিয়া সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০০ গ্রাম এমপি সার সমানভাগে দুই ভাগ করে নিতে হবে।
- তারপর বর্ষার আগেও পরে প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে এক মিটার দূরত্বে যতটুক জায়গা দুপুরের রোদের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় ছিটিয়ে দিয়ে ভালোভাবে কোদাল দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এভাবে দুইবার সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
লটকনের সিজন
প্রতিটি ফল হওয়ার বা পাকার যেমন নির্দিষ্ট সৃজন বা সময় রয়েছে। তেমনিভাবে
লটকনের সিজন ও রয়েছে। বিভিন্ন মৌসুমে যেমন বিভিন্ন ফল হয়ে থাকে তেমনি ভাবে
লটকনও একটি নির্দিষ্ট মৌসুমেই হয়। এই ফলটি হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি সিজন বা
মৌসুম রয়েছে। শীতের শেষের দিকে অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষের দিকে লটকনের ফুল ধরা শুরু
করে। আষাঢ় মাসের শেষের দিকে বা শ্রাবণ মাসে শুরুর দিকে এই ফল পাকতে শুরু করে। আর
এটি বর্ষার মৌসুমী ফল হিসেবেও সুপরিচিত।
লটকনের জাত সমূহ
প্রতিটি ফলের যেমন ভিন্ন ভিন্ন জাত রয়েছে। তেমনিভাবে লটকনেরও কয়েকটি উন্নত ও
উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম উন্নত কয়েকটি জাত হলোঃ
- FTIP-BAU লটকন-১ এই জাতটিকে আবার গৌরীপুরী লটকন বলা হয়। এই জাতের লটকন প্রতি হেক্টর জমিতে ৮ থেকে ১০ টন উৎপাদিত হয়। এই জাতের লটকন চাষে তেমন ভাবে সেচের প্রয়োজন হয় না। এই জাতের লটকনের সুন্দর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি নিয়মিত ও আগাম জাত, লটকনের একটি ফলের ওজন ২০ থেকে ৩৫ গ্রাম হয়ে থাকে, আর এটি বামন জাত হওয়ার কারণে ফলগুলো গুচ্ছ ভাবে খুব বেশি আকারে গাছে ধরে।
- বারি লটকন-১ এই জাতটি বাংলাদেশের চাষের জন্য ২০০৮ সালে অনুমোদন করা হয়েছে। এটাকে মাঝারি জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে পাকতে শুরু করে এবং গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা প্রায় ৩৩৪ টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার এটি একটি নিয়মিত ও উচ্চ ফলনশীল জাত হিসেবে স্বীকৃত। প্রতি হেক্টর জমিতে এই জাতের লটকন সাড়ে ১২ টন উৎপাদন হয়ে থাকে। এইটাতে লটকনের এক একটির ওজন প্রায় ১৪ গ্রাম হয়ে থাকে। প্রতিটি লটকনেই চার থেকে পাঁচটি করে নরম বীজ, শাঁস বা টক মিষ্টি কুয়া থাকে। আর এই জাতের লটকন বাংলাদেশের সর্বত্রই চাষের উপযোগী।
লটকন খেলে কি হয়
প্রতিটি ফল বা খাবার খেলে কিছু না কিছু উপকার হয়েই থাকে। তবে লটকন খেলে
কয়েকটি জাদুকরী উপকার হবে। এগুলো হলোঃ
- লটকন খেলে প্রথমত ক্ষুধা নিবারণ হয়। বমি বমি ভাব দূর হয়ে যায়। এবং মানসিক অবসাদ দূর করে।
- মানব দেহ গঠন ও শরীরের যাবতীয় কোষকলা সুস্থ এবং উজ্জীবিত রাখতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।
- মানব দহের কোষগুলোর সব ধরনের ক্ষয় রোধ করে এবং ক্ষয় হয়ে থাকলে সেটি খুব দ্রুত পূরণ করে।
- লটকনে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, আয়রন এ ধরনের যাবতীয় খনিজ উপাদানে ভরপুর থাকার কারণে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
লটকনের বিচি খেলে কি হয়
লটকনের বীজ বা বিচিতেও অনেক ধরনের ঔষধি পুষ্টিগুণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হল লটকনের বীজ খেলে গনোরিয়া রোগ ভালো হয়। এছাড়াও পেটের বিভিন্ন ধরনের রোগের
চিকিৎসায় প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার লটকনের বীজ বা বিচি একধরনের
মূল্যবান রং উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এই মূল্যবান রং সিল্ক, সুতা ও
পোশাকশিল্পে ব্যবহার করা হয়।
লটকনের পাতা খেলে কি হয়
লটকনই যে শুধুমাত্র ঔষধি গুনাগুনে সমৃদ্ধ শুধু তাই নয়! লটকন গাছের ডাল, পাতা,
শিকড় সবকিছুর মধ্যেই ঔষধি গুনাগুন বিদ্যমান। লটকন গাছের কাঁচা পাতা শুকিয়ে
গুড়া করে খেলে ডায়রিয়া, আমাশয় ও মানসিক চাপ কমে যায়। এছাড়াও লটকন গাছের
শিকড় ও পাতা খেলে পেটের নানা ধরনের রোগ ও সমস্যা দূর হয়ে যায়। আবার লটকন গাছের
ছাল ও পাতা চর্মরোগ দূর করতে সাহায্য করে।
লটকন খেলে কি ওজন বাড়ে
লটকন খেলে ওজন বাড়ে না বরং দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে। যারা অনেক মোটা বা
যাদের অতিরিক্ত মেদ রয়েছে লটকন তাদের জন্য বেশ উপকারী একটি ফল। লটকনে ফ্ল্যাট ও
কার্বোহাইড্রেট খুব সীমিত পরিমাণে থাকার কারণে শরীরের মেদ কমাতে ব্যাপকভাবে
সাহায্য করে। যারা অতিরিক্ত ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তাদের দুশ্চিন্তার দিন
শেষ। কারণ অতিরিক্ত মেদ বা ওজন কমাতে লটকন পাশে আছে।
লটকন খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে
ডায়াবেটিস রোগীদের একটাই ভয় কিছু খেলেই যদি ডায়াবেটিস বেড়ে যায়! তবে চিন্তার
কোন কারণ নাই লটকনে থাকা অ্যামাইনো এসিড ও এনজাইম দেহকে মজবুত করে গঠন করে। এই
সমস্ত উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এজন্য দেহের
যাবতীয় কোষের ক্ষয় রোধ ও ক্ষয় পূরণ হয়। ফলে মানব দেহের কোষকলা গুলো সম্পূর্ণ
সুস্থ ও উজ্জীবিত থাকে। আর লটকনে থাকা সব
ধরনের ভিটামিন, আয়রন, শর্করা ও খনিজে ভরপুর থাকার কারণে রক্তের শর্করা বা ব্লাড
সুগার নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা লটকন ফলটি কোন
চিন্তা ছাড়াই অনায়াসে খেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় লটকন খাওয়ার উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় লটকন খাওয়ার উপকারিতা অনেক। গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মহিলাদের বিভিন্ন
ধরনের খাদ্যশক্তির মাধ্যমে অনেক ধরনের পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আর এই ধরনের সকল
পুষ্টিকর চাহিদা পূরণ করে লটকন। এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মা ও শিশুকে বিভিন্ন
ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে। সন্তান প্রসবকালীন সময়ে প্রসবের নানা ধরনের জটিলতা
থেকে মুক্ত রাখে। গর্ভাবস্থাতে লটকন খেলে কোন সমস্যা নেই তবে চিকিৎসকের পরামর্শ
অনুযায়ী খেতে হবে।
লটকনের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
লটকনের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা ব্যাপক। নিম্নে লটকনের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলোকরা হলো।
লটকন খেলে সারবে যেসব রোগ
লটকন এমন একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ ও ঔষধি গুনাগুন সমৃদ্ধ ফল যেটি খেলে নানা ধরনের রোগ
সেরে যায়।
যেমনঃ
- বিভিন্ন ধরনের শারীরিক দুর্বলতা।
- বুক ধরফর করা।
- ঠোঁট, পায়ের তালু ও গোড়ালি ফাটা রোধ করে।
- ঠোঁট ও মুখের ভিতরের ঘা এবং শরীরের বিভিন্ন ধরনের ঘা-পাচড়া ভালো করে।
- বারবার গলা শুকিয়ে যাওয়া দূর করে।
- দাঁতের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে ও দাঁতকে মজবুত রাখে।
- সাথে সাথে মাড়ি ও ত্বকের যে কোন সমস্যা দূর করে।
- ক্লোন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
লটকন শক্তিতে কাঁঠালের দ্বিগুণ
প্রতিটি ফলেই কিছু না কিছু গুনাগুন থাকেই। কোন ফলে অনেক বেশি শক্তি বা গুণাগুণ
থাকে আবার কোন ফলে অনেক কম থাকে। মহান আল্লাহ তা'আলা প্রতিটি ফলকেই মানব দেহের
জন্য এক একটি অমূল্য প্রতিষেধক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। সেক্ষেত্রে যাবতীয়
পুষ্টিগুণ ও উপকারিতার দিকে লক্ষ্য করলে লটকন শক্তিতে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালের
ও দ্বিগুণ।
লটকনে কি এসিড আছে
প্রতিটি মৌসুমীর ফলেই বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, অ্যাসিড, শর্করা কিংবা আয়রন এর মত
পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে। কিন্তু উল্লেখিত পুষ্টি উপাদান গুলো কোন হোমমেড
খাবারে তেমনভাবে এগুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু লটকন একটি ছোট ফল
হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। মহান আল্লাহ তা'আলা
সৃষ্ট এই অম্ল ও সুমিষ্ট ফলে এনজাইম ও অ্যামাইনো এসিড এর মত মূল্যবান অ্যাসিড
প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে।
লটকনে কি কি ভিটামিন আছে
লটকন এমন একটি উপকারী ও ঔষধি ফল। যাতে অনেক ধরনের ভিটামিন বিদ্যমান রয়েছে। তার
মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন বি, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২ । এই ভিটামিনের
পরিমাণগুলো যথাক্রমে ১০. ০৪ মিলিগ্রাম এবং ০.২০ মিলিগ্রাম বিদ্যমান রয়েছে।
এছাড়াও প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও
ক্রোমিয়াম আছে। এছাড়াও পরিপক্ক লটকনের প্রতি ১০০
গ্রাম শাঁস বা কোয়াতে খনিজ উপাদানের পরিমাণ ০.৯ গ্রাম ও লৌহ ০.৩ গ্রাম রয়েছে।
এছাড়াও লটকন প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বিদ্যমান রয়েছে। এতে অতিমাত্রায়
ভিটামিন সি থাকায় লটকনের মৌসুমে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি লটকন খেলেই
একজন মানুষের দৈনন্দিন ভিটামিন 'সি'র চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। পাকা লটকন অন্যান্য
যে কোন ফলের তুলনায় খাদ্যমানের দিক দিয়ে খুবই সমৃদ্ধ ও খুবই উপকারী ফল।
লটকনে কত ক্যালরি আছে
প্রতিটি মৌসুমী ফলেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ক্যালোরি বিদ্যমান থাকে। তবে এর
মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণে ক্যালরি থাকে লটকনে। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনের শ্বাস বা
কোয়ার ভিতরে খাদ্যশক্তি হিসেবে প্রায় ৯২ কিলোক্যালরি মৌজূদ থাকে। এইজন্য লটকন
খেলে খাদ্যাভাব দূর হয়ে যায়। এছাড়াও প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে আয়রনের পরিমাণ
থাকে ৫.৩৪ মিলিগ্রাম। আবার লটকনে অল্প পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাটও থাকে। প্রতি ১০০
গ্রাম লটকনে প্রোটিনের পরিমাণ থাকে ১.৪২ গ্রাম আর ফ্যাটের পরিমাণ থাকে ০.৪৫
গ্রাম।
লটকনের উপকারিতা
প্রচুর পরিমাণে লটকনের উপকারিতা রয়েছে। লটকনের উপকারিতা গুলো বলে শেষ করা যাবে
না।
নিম্নে লটকনের উপকারিতা গুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি তুলে ধরা হলোঃ
- লটকনের শ্বাস বা কোয়ায় জলীয় অংশ বা পানির পরিমাণ অনেক বেশি থাকায় এটি খেলে শরীর হাইড্রেটেড হয়ে থাকে।
- বর্ষাকালের এই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার কারণে আমাদের ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ রোগ দেখা দিতে পারে। এইজন্য নিয়মিত লটকন খেলে চর্মরোগ থেকে তো মুক্তি পাবেন সাথে সাথে এটা ত্বকের রুক্ষতা ও ত্বক ফেটে যাওয়া থেকেও প্রতিরোধ করবে।
- বর্ষাকালের দ্বিমুখী আবহাওয়ার কারণে জ্বর, সর্দি, কাশি, ফ্লু এই ধরনের সংক্রমণ রোগ হতে পারে। এই ধরনের সংক্রমণজনিত রোগের কবল থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত লটকন খান।
- লটকনে থাকা ভিটামিন 'সি' শরীরে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করে। এইজন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বৃদ্ধি হতে থাকে। ফলে শরীরের সব ধরনের ঘা-পচড়া তাড়াতাড়ি শুকাতে সাহায্য করে।
- লটকনে থাকা ভিটামিন 'সি' হাড় ও দতকে মজবুত করে তোলে এবং ত্বক সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখে।
- প্রতিদিন তিনটা চারটা লটকন খেলে শরীরে ভিটামিন 'সি'র চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। ফলে স্কার্ভি রোগকে প্রতিরোধ করে।
- লটকনে থাকা কয়েক ধরনের ভিটামিন 'বি'র কারণে শরীরে বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এবং চোখের ভিতরের রক্তনালির সংকোচন প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে।
- লটকনে রক্ত ও হাড়ের জন্য সব থেকে উপকারী উপাদান আয়রন রয়েছে। এইজন্য এটি রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাথে সাথে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়ামের মত উপকারী খনিজ উপাদান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
- লটকনে ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট খুব সীমিত পরিমাণে থাকায় এটি সব ধরনের বয়সের মানুষ খেতে পারেন। এবং এটি অতিরিক্ত মেদ বা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
- লটকন টক-মিষ্টি স্বাদের সুস্বাদু ফল হওয়ায় মুখের রুচি বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও লটকনের উপকারিতা নানাভাবে লক্ষ্য করা যায়।
লটকনের অপকারিতা
- লটকনের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ যেমন ব্যাপক পরিমাণে রয়েছে। তেমনিভাবে প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত পরিমাণে লটকন খেলে ক্ষুধামন্দা বা ক্ষুধাহীনতায তৈরি হতে পারে।
- প্রতিদিন দুইটা তিনটা বা চারট লটকন আরামসে খেতে পারেন। এতে কোন সমস্যা নাই। তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়!
- লটকনে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে কিডনি রোগীদেরকে এটি অল্প করে খেতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই কিডনি রোগীরা লটকন খেতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবেন। তাহলে লটকনের উপকারিতা গুলো সঠিক মাত্রায় নিতে পারবেন।
লেখকের ইতি কথাঃ লটকনের উপকারিতা সম্পর্কে
সম্মানিত পাঠক আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ে লটকনের উপকারিতা ও জাদুকরি সব গুনাগুন
সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। লটকন মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি ছোট্ট একটি
ফল হতে পারে। কিন্তু এর উপকারিতা ও গুণাগুণ গুলো খুবই অবাক করার মত। তাই আপনি যদি
লটকনের উপকারিতা ও পুষ্টি সমৃদ্ধ গুনাগুন গুলো পেতে চান। তাহলে উপরের বিষয়গুলি
মাথায় রেখে লটকন খেতে হবে।
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থেকে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের
ওয়েবসাইটে এই ধরনের তথ্যবহুল আর্টিকেল আমরা নিয়মিতই পোস্ট করে থাকি। তাই আপনি
যদি এই ধরনের আরোও তথ্যবহুল পোস্ট পড়তে চান। তাহলে এই ওয়েব সাইটটি নিয়মিত ফলো
করুন। লটকনের উপকারিতা নিয়ে যদি আপনার কোন মতামত বা প্রশ্ন থাকে তাহলে নিচে
দেয়া মতামত বক্সে কমেন্ট করে জানান। আবার কথা হবে নতুন কোন আর্টিকেল নিয়ে।
ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ ও সুস্থ থাকুন!
কনফিডেন্স আইটি নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url